দ্য আজাদ স্টাফ
ফরহাদ মজহার
“বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা ১৯৮০ থেকে ২০১০-এর মধ্যে যে অর্থনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে তাকে টাকামুখীন (financialization) ব্যবস্থা হিশাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
এটা মার্কসবাদিরা ‘লগ্নি পুঁজি’ বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে আলাদা। অর্থাৎ টাকা — বিশেষত ডলার কিভাব ছাপা হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী ডলার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কিভাবে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদকে নতুন করে কার্যকর রাখা হচ্ছে ইত্যাদি বোঝানো হয়।
অর্থনৈতিক মুনাফার প্রধান অংশই অংশ আসে টাকা বা ডলারের বিচলন ক্ষেত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ খাটিয়ে।
বলা বাহুল্য এই ক্ষেত্রে শেয়ারবাজার ও ব্যাঙ্ক বিশ্বব্যবস্থা চালু রাখা ও মুনাফা কামানোর প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে, ডিজিটাল টেকনলজি বা ইনফরমেশান হাইওয়ে তাকে আরো গতিমান করে তোলে।
নব্য মূদ্রাব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা দুর্বল রাষ্ট্রের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্রের খবরদারি এবং আইনের বাইরে যারা বিপুল পরিমান মুনাফা কামাতে পারে এবং রাষ্ট্রের বাইরে তাদের নিজস্ব বল প্রয়োগের বাহিনী দ্বারা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম তারা ভয়ানক শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
তাদের দাপট বাড়ে। এরাই নব্য বিশ্ব ‘মাফিয়া’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে যারা আইনের ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা করে না।
দুর্বল রাষ্ট্রগুলো ক্রমশ তাদের কব্জায় ও নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রাষ্ট্র হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক নিয়ম ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে যে কোন উপায়ে মুনাফা কামানো।
রাষ্ট্র এদের কাছে তুচ্ছ ও মুনাফা লুট করবার ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার ছাড়া কিছুই না। রাষ্ট্র কার্যত অর্থহীন , তবে দমন পীড়ন , সন্ত্রাস ও নির্বিচার বল প্রয়োগের জন্য এরা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে।
জনগণ বলাবাহুল্য আন্দোলন/বিক্ষোভ করে। তখন সেইসব ম্যনেজ বা সামাল দেবার প্রশ্ন ওঠে। তখন ‘সুশাসন’, ‘নির্বাচন’ , ‘আইনের শাসন”, ‘গণতন্ত্র’ ইত্যাদি অন্তঃসারশূন্য কথা ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে চালাচালি ও চিল্লাবাল্লা করতে দেওয়া হয়।
কিন্তু যতক্ষণ না জনগণ ‘রাষ্ট্র মেরামত’ বা নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের কথা না ভাবছে ততক্ষণ এইসব তামাশা চলতে থাকে।
‘সুশীল সমাজ’ ব্যাপারটা বাংলাদেশের খুবই প্রতিভাবান আমদানি। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক পরিসর ও রাজনৈতিক পরিসরের সম্পর্ক অস্পষ্ট করে তোলা এবং সমাজে একটি অভিজাত শ্রেণি তৈরি করা যাদের কাজ বিদ্যমান ব্যবস্থার বেসামাল চরিত্র সামাল দেওয়া এবং জনগণকে ধোঁকা দিতে থাকা।
বিপরীতে ‘সিভিল সোসাইটি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যার প্রাচীন অর্থশাস্ত্রীয় মানে হোল বৈষয়িক সামাজিক সম্বন্ধ (Civil Society), যার ওপর আধুনিক রাজনৈতিক সমাজ (Political Society) গড়ে ওঠে।
সিভিল সোসাইটি মানুষের জীবমূলক চাহিদা মেটানোর পরিসর। বেঁচে থাকতে হলে সমাজে বা সিভিল সোসাইটির পরিসরে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই ব্যক্তিকে টিকে থাকতে হয়, সেখানে আমরা ‘অনেক’। মানুষের সঙ্গে মানুষে অর্থনৈতিক অবস্থা অসম ও বৈষম্যমূলক।
আর যে পরিসরে আমরা নিজেদের রাষ্ট্রের সদস্য অনুমান বা গণ্য করি সেটা রাজনৈতিক সমাজ। সেখানে অনুমান যে সবাই সমান এবং নাগরিক, সেখানে আমরা সবাই এক, অর্থাৎ সমাজে আমরা ‘অনেক’ হলেও রাজনৈতিক সমাজে আমরা নিজেদের একই সমাজের অন্তর্গত ভাবি।
তাই প্রত্যকে ভোটও একটি। নাগরিক হওয়ার অর্থ আমাদের একটি রাজনৈতিক পরিসর আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে , আমরা নাগরিক না। এবং আমাদের কোন রাজনৈতিক পরিসর নাই। আমরা একটি মাফিয়া গোষ্ঠি দ্বারা মাফিয়া রাষ্ট্রে শাসিত হচ্ছি।”