দ্য আজাদ স্টাফ
দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি এটি। দেশের পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। শিক্ষার্থীরা এখান থেকে পাস করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আবার বিভিন্ন দেশে পিএইচডি করে চাকরিও নিয়েছেন—বলছিলাম চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) এর কথা।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কর্তৃক এক ছাত্রকে নির্যাতনের পর সংঘর্ষের আশঙ্কায় গত বুধবার (২৯ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের শেষের দিক থেকেই ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, শিক্ষকদের প্রাকশ্যে হুমকি, সাধারণ শিক্ষার্থীকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধরসহ নানা কার্যকলাপের কারণে নিয়মিতই আলোচনায় ছিল ছাত্রলীগ। যদিও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কোন কমিটি নেই। চট্টগ্রাম জেলা উত্তর ছাত্রলীগের পরিচয়ে তারা এখানে কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলে জানা গেছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, সকল ঘটনার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই দায়ী। তাদের সামনেই ছাত্রলীগ নামধারীরা ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়তই নৈরাজ্যে করেই যাচ্ছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ছাত্রলীগের এসব বিষয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। তারা কোন প্রকার সহায়তা না করায় এসব বারবার ঘটছে। তবে আগামীতে এসব বিশৃঙ্খলকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীণ শৃংখলা ভঙ্গের কারণে ছাত্রত্ব বাতিল ও সেমিস্টার বাতিল হয় ২৭ জন শিক্ষার্থীর। এদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠে ছাত্রলীগ।
২০১৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজ দলীয় ব্যানারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি না থাকায় রাজনৈতিক সংগঠনের নামে ফুল না দিয়ে তখন ছাত্রদের পক্ষ থেকে ফুল দিতে বলে প্রশাসন। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসলে পরের দিন সদ্য বাদ পড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বির্তকিত সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে নেতাকর্মীরা। এরপর শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হয়। পরবর্তীতে এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানো হয়।
শহীদ মিনারে নেতাকর্মীদের সাথে গোলাম রাব্বানী জানা যায়, এরপর থেকে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া ছাত্রলীগ। বিভিন্ন ছলে-কৌশলে চেষ্টা চালায় তারা। ক্যাম্পাসে ছেলেদের দুটি হল রয়েছে। ওই বছর ১৫ ডিসেম্বর হলে ছাত্রলীগের কর্মীরা হলে প্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় হলের সাধারণ ছাত্ররা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে উপাচার্যকে বিষয়টি লিখিত অভিযোগ করে।
তবে পরদিন ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগের বিজয় দিবসের বইমেলায় হামলা চালায় ছাত্রলীগের কর্মীরা এবং ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ওইদিন প্রথম হল ভ্যাকেন্ট করা হয়। এর আগে কখনও কোন পরিস্থিতিতে হল বন্ধ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
এরপর ২০১৯ সালের ১১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়া দখল করে প্রায় ২৩ হাজার টাকা ছিনতাই করে নেওয়া হয়। এরপর অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এখনও খোলা হয়নি। ফলে ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হতো।
পরে ১৮ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সামনে আইন বিভাগের ছাত্র ওসমান গণিকে নির্মমভাবে মারধর করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। ছাত্রলীগের প্রশ্রয়ে ২ ফেব্রুয়ারি আবাসিক হলে অবৈধ ছাত্ররা প্রবেশ করে। সেদিন হলের বিভিন্ন রুম থেকে ১১টি ল্যাপটপ চুরি হয়, লুটপাট হয় নগদ লক্ষাধিক টাকা। অনেক ছাত্রের সার্টিফিকেট চুরি করা হয়, অাবার অনেক একাডেমিক বইপুস্তক চুরি করে বাহিরে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
১১ ফেব্রুয়ারি আবু বকর (রা.) হলের ৫০৮ নাম্বার রুমের আসাদুজ্জামান নামক একজন ছাত্রকে রাতভর প্রহর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে সহকারী প্রক্টর আল্লামা ইকবাল ওই ছাত্রকে উদ্ধার করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি আব্দুর রহমান সাইফ নামে কোর’আনিক সাইন্সের আরেকজন ছাত্রকে হলে ডেকে এনে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইএলএল ডিপার্টমেন্টের মেহেদী হাসান নামক একজন ছাত্রকে বিভাগীয় চেয়ারম্যানের রুম থেকে ১০-১৫ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জোর করে ধরে নিয়ে সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ার দ্বিতীয় তলায় নিয়ে চরম নির্যাতন করে। এসময় তার মোবাইল কেড়ে নেয়া হয়। তখন ছাত্রলীগের তাদের একটি গ্রুপ (মহসিন, ওলি) ওই ছাত্রের কাছে চাঁদাও দাবি করে।
২৭ মার্চ কথিত ছাত্রলীগ নেতা মিফতাউল হাসান আনাস এলাকার এক তরকারি ব্যবসায়ীর সাথে ঝামেলায় জড়ায়। পরবর্তীদের হল থেকে অস্ত্রসস্ত্রসহ ওই ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করা হয়। যেখানে সুব্রত শুভ, রিদওয়ান ইমু, রবিউল ইসলাম রনিদের অস্ত্র হাতে দেখা যায়।
ওই বছরের ৮ মে অটাম’১৮ এর ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হলে ইইই ডিপার্টমেন্টের আনাস, ডলার, নাঈম, তানভীর অকৃতকার্য হয়। তারা ছাত্রলীগের কর্মী। এ ঘটনায় ইইই ডিপার্টমেন্ট শিক্ষকদের রুমে গিয়ে অবৈধভাবে পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য জোর-জবরদস্তি করে এবং স্যাররা অনৈতিক কাজ করতে পারবেন না বলে অস্বীকার করলে তারা স্যারদের রুম ভাংচুর করে। ওইদিন আনাস, ডলার, মুরাদসহ আরও কয়েকজন ছাত্রলীগের কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. দেলাওয়ার হোসাইনকে মুঠোফোনে কল দিয়ে অকৃতকার্য করার কারণ জানতে অশ্রাব্য ও বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করে। পরে তারা শিক্ষক ডরমিটরিতে গিয়ে তার বাসভবনে হামলা চালায়, সিকিউরিটি ও উপস্থিত শিক্ষকবৃন্দের তাৎক্ষণিক পদক্ষপে তারা নিবৃত্ত হয়। পরে ড. দেলাওয়ার ডিনের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। জানা যায়, সে সময় রমজান মাস চলেছিল, তারাবীর নামাজ চলাকালীন সময় তখন তারা ক্যাম্পাসে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিলও করে।
৯ মে শিক্ষকদের বাসায় হামলা চালায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। এসময় কলাপসিবল গেট খুলতে গিয়ে ছাত্রলীগের কর্মী ডলারের হাত কেটে দেয়, যেটাকে জায়ামাত-শিবিরের হামলা বলে চালানোর চেষ্টা করে গুজব রটায়। এসময় হলের সকল ছাত্রকে মিছিলে আসতে বাধ্য করলে কয়েকজন ছাত্র রাজী হয়নি। পরবর্তীতে সেই ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়, এতে ইইই ডিপার্টমেন্ট এর ৮ম সেমিস্টারের নোমানের মাথা ফেটে যায়। পরে হাসপাতালে ২ দিন চিকিৎসাধীন থাকে নোমান। এসব ঘটনারও এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিটি কিংবা প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
২১ জুলাই মারুফুল হাসান রিজভী নামের ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্ট এর একজন শিক্ষার্থীকে এসডিডাব্লিওডি অফিস থেকে রবিউল হোসেন রনি নামক একই বিভাগের আরেকজন ছাত্রলীগ নেতা জোরজবরদস্তি করে সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ার দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। এসময় অন্য ছাত্রলীগ নেতাদের ডাকে রনি। তখন মারুফুল হাসান রিজভীর উপর চরম নির্যাতন চালায় তারা।
১৭ আগস্ট ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী ওয়াসী উদ্দিন জিতুকে মুরাদ, মহসিন, আনাস, নাঈমসহ কয়েকজন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হলে আটকে রাখে। এসময় তার মোবাইল, এটিএম কার্ড, নগদ টাকা, এটিএম কার্ডের পিনকোডসহ নিয়ে যায় তারা। পরে শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও পরে ছিনতাই হওয়া মালামাল ফেরত চাইলে তাকে মেরে পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এসব বিষয় প্রশাসন জানলেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরূদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি।
গত ৭ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে ত্রিপলি বিভাগের চেয়াম্যানকে লাঞ্ছিত করেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করলেও প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ড. মুহাম্মাদ শামিমুল হক চৌধুরী জানান, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্লাস চলাকালীন সময়ে আমাদের বিভাগের ছাত্রদেরকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করে। এসময় আমার সাথে তাদের বাকবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে তারা আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলে। এছাড়াও আমাকে পারিবারিকভাবেও হুমকি-ধমকি দেয়।
সবশেষ, গত ২৮ জানুয়ারি শিবির আখ্যা দিয়ে এক ছাত্রকে মারধর করলে পরের দিন ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। এসময় সংঘর্ষের আশঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের নৈরাজ্যের পেছনে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী। কেননা তারা দেখছে বারবার একই ছেলেগুলো এরকম ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে।
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দেয়া জুবায়ের ইসলাম ডলার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ক্যাম্পাসটি শিবিরের ঘাঁটি ছিল। ২০১৮ সালের শেষের দিকে আমরা ক্যাম্পাসে দখলে নেই। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা নেই, সব ক্যাম্পাসের মতোই এখানে ছাত্র রাজনীতি চলবে। তবে অনেক সময় আমাদের বিরূদ্ধে কিছু শিক্ষক প্রপোগন্ডা চালায়।
হলের সামনে পাহাড়ের ভেতর ছাত্রলীগের নেশার আড্ডাখানা সম্প্রতি ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়াটাও এক ধরণের প্রপোগন্ডা দাবি করে তিনি বলেন, শিবিরের এক ছেলেকে ধরে মারধর করলে সেটি প্রপোগন্ডা ছড়িয়ে তারা (শিক্ষক) ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিয়েছে। এ ঘটনায় যদি আমাদের কারও দোষ থাকে তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়াটা কোন কাম্য নয়।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক কে এম গোলাম মহিউদ্দীন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এসব বিষয়ে আমি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি। তারা যদি আমাদের সহায়তা না করে, তাহলে কীভাবে চলব? তবে আগামীতে এসব বিশৃঙ্খলাকারীদের সহ্য করা হবে না। আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।
ক্যাম্পাস খোলার ব্যাপারে তিনি বলে, শিগগিরই ক্যাম্পাস খুলে দেয়া হবে। আগামীকাল সোমবার এ বিষয়ে একটি মিটিং আছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হতে পারে। হয়তো এ সপ্তাহেও ক্যাম্পাস খুলে দেয়া যেতে পারে। সূত্র টিডিসি