দ্য আজাদ স্টাফ
সকাল থেকেই রায়েরবাজারের বিভিন্ন নির্বাচনীকেন্দ্র এলাকায় মহড়া দিচ্ছিল সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। বুকে তাদের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ সমর্থিতপ্রার্থী আতিকুল ইসলামের নৌকা ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন খোকনের টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকের ব্যাচ ঝুলানো। হাতে তাদের নানা দেশীয় অস্ত্র। এই দুর্বৃত্তদের ছবি ধারণ করতে গিয়ে তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহন হন বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও আগামীনিউজ ডটকমের রিপোর্টার মোস্তাফিজুর রহমান সুমন। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে সেখানে আহত হন আরো এক সাংবাদিক। এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গতকাল দুর্বৃত্তদের মহড়া দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে প্রকাশ্যেই অস্ত্র উঁচিয়ে তারা মহড়া দেয়। তাদের মূল টার্গেট ছিল সাংবাদিকরা। মুস্তাফিজুর রহমান সুমন ছাড়াও গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আরো অন্তত হাফ ডজন সাংবাদিক আহত ও নাজেহাল হয়েছেন।
রায়ের বাজার এলাকায় সুমন আহত হন সোয়া ১১টার দিকে। ওই এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়ার খবর শুনে তিনিসহ কয়েকজন সাংবাদিক ওই এলাকায় যান। সুমন অস্ত্রধারীদের ছবি ধারণ করতে গেলে দুর্বৃত্তরা তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তারা কুপিয়ে এবং পিটিয়ে সুমনকে রক্তাক্ত করে। আহত অবস্থায় তিনি রাস্তার ওপর পড়ে যান। দুর্বৃত্তরা সুমনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে যায়। এই ঘটনার সময় কাছেই অবস্থান করছিল পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির গাড়ি। তারা সুমনকে উদ্ধারের কোনো চেষ্টাই করেনি বলে তার সহকর্মীরা অভিযোগ করেন। তার সহকর্মী আজমীর জানান, একপর্যায়ে তিনি সুমনকে উদ্ধার করতে গেলে দুর্বৃত্তরা অস্ত্র দিয়ে তাকেও আঘাত করে। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। দৃশ্য দেখে আরো কয়েকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা তাদের ওপরও হামলে পড়ে। এ সময় আরো দু’জন সামান্য আহত হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। এ সময় সংবাদকর্মীরা সেখানে উপস্থিত এডিসির কাছে সহায়তা চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি দেখছি। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সুমনকে উদ্ধারে এগিয়ে না আসায় স্থানীয় দুই যুবকের সহায়তায় সহকর্মীরা উদ্ধার করে সুমনকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে তাকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর জন্য বলেন ডাক্তার। সহকর্মীরা তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যখন পৌঁছে তখন সুমনের জ্ঞান ছিল না। সেখানে নেয়ার পর দ্রুত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতালে নেয়ার ঘণ্টা দেড়েক পর তার জ্ঞান ফেরে। আহত অবস্থায় সুমনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে দেখার জন্য গতকাল দুপুরের দিকে হাসপাতালে যান র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এই ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে বলে আশ^াস দিয়েছেন র্যাব ডিজি। এ ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নাজেহাল করেছে। তাদের আইডি কার্ড, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আহতরা হলেনÑ ফটো এজেন্সি প্রেস বাংলা এজেন্সির (পিবিএ) বিশেষ প্রতিনিধি ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের স্থায়ী সদস্য জিসাদ ইকবাল, জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান আলোকচিত্রী শেখ হাসান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদক মাহবুব মমতাজি, ডেইলি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদক নূরুল আমিন এবং পরিবর্তন ডটকমের ফটো সাংবাদিক ওসমান গনি। সকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাদারটেক স্কুল কেন্দ্রে কালের কণ্ঠের প্রধান আলোকচিত্রী শেখ হাসানের ওপর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালায়। এ সময় হামলাকারীরা শেখ হাসানের ক্যামেরার মেমোরি কার্ড নিয়ে যায়। এ ছাড়াও দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রামপুরার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে দ্য ডেইলি স্টারের এক সাংবাদিকের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা। পরে অবশ্য সেটি ফিরিয়ে দেন তারা। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাজনীন স্কুল কেন্দ্রে মানবজমিনের এক নারী সাংবাদিকের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় সরকার দলের নেতাকর্মীরা। পরে মোবাইলের ছবি ডিলিট করে সেটি ফেরত দেয় তারা। গতকাল শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে লাঞ্ছিত করে তিন সাংবাদিককে বের করে দিয়েছে নৌকার কর্মীরা। এ সময় নয়া দিগন্তের স্টাফ রিপোর্টার শামছুল ইসলাম, ইনকিলাবের স্টাফ রিপোর্টার ফারুক হোসেন ও জাহিদুল ইসলামের নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়। এর পরপরই ভোটকেন্দ্রে হট্টগোলের সৃষ্টি হলে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করতে থাকেন তিন সাংবাদিক। এ সময় নৌকার সমর্থকরা তাদের গালিগালাজ করে মোবাইল কেড়ে নিয়ে সব তথ্য মুছে ফেলে। বিষয়টি দায়িত্বরত পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব হোসেনের সামনে ঘটলেও তিনি সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত না করে উপরন্তু সাংবাদিকদের কেন ভিডিও করলেন বলে প্রশ্ন করেন। কেন্দ্রে কোনো বিশৃঙ্খলার ভিডিও ধারণে নিষেধাজ্ঞা আছে কি না এমন প্রশ্ন করলে তিনি সাংবাদিককে নিরাপদে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দেন। বেলা ১১টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাদারটেক আব্দুল আজিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে গেট লাগিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে শত শত নৌকার সমর্থক অবস্থান করছে। সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীর অভিযোগ, পোলিং অফিসাররা ভোটারদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের বুথ থেকে বের করে দিয়ে গোপন বুথে প্রবেশ করে নৌকার বাটনে চাপ দিয়ে ভোট দিচ্ছে নৌকার কর্মীরা। পরে ওই বুথে গিয়ে পোলিং এজেন্ট শিউলি জানান, স্থানীয় পুলিশের লোকজন এসে নৌকায় ভোট দিতে বলে গেছে। কোনো সমস্যা করলে পরে দেখে নেয়া হবে বলে হুমকিও দিয়ে গেছে। এই সুযোগে নৌকার সমর্থকরা ভোটারদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ভোট কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে গোপন কক্ষে গিয়ে ভোট দিচ্ছে। পোলিং এজেন্টের এমন অভিযোগের বিষয়ে নীরবতা পালন করেন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার তাহমিনা বেগম। এ ঘটনায় প্রিজাইডিং অফিসার মফিজুল হকের দৃষ্টি আকষণ করা হলে তিনি বলেন, আমি মাত্র অভিযোগ পেলাম। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। এ দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ভোটের তথ্য সংগ্রহে অবরুদ্ধ ও শারীরিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাহবুব মমতাজী এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নুরুল আমিন জাহাঙ্গীর। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিক মাহবুব মমতাজী জানিয়েছেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গেন্ডারিয়ার ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদরাসা ভোটকেন্দ্রে তথ্য সংগ্রহে যান তিনি। বেলা পৌনে ১১টার দিকে একটি বুথে দুই ভোটার তাদের ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। আমরা ওই দুই ভোটারের ছবি তুলি এবং তাদের মতামত নিই। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বের হয়ে আসার সময় আমাদের পথ আটকান গেন্ডারিয়া থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রিয়াদ। জামার কলার ধরে টানাহেঁচড়া ও ইসির দেয়া ভোট পরিদর্শন কার্ড ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এ সময় তাদের কাছে থাকা নোট বইও ছিঁড়ে ফেলা হয়। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন মাহবুব। মোবাইল ফোন উদ্ধারে ভোটকেন্দ্রের ইনচার্জ গেন্ডারিয়া থানার এসআই মাহমুদ এবং এএসআই আরিফকে বিষয়টি জানানো হয়; কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন মাহবুব ও জাহাঙ্গীর। তারা বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারা ছাত্রলীগ নেতাকে কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। পরে দুই সাংবাদিক প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে গেলে তারাও অপরাগতা জানান। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের ওয়ারী জোনের এসি হান্নানুল ইসলাম সেখানে যান। তার উপস্থিতিতেই সাংবাদিকদের মোবাইল ফোনের যাবতীয় তথ্য ও ছবি মুছে ফেলা হয় বলে জানান মাহবুব। এরপর প্রায় এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর ওই ভোটকেন্দ্র থেকে বের হতে পারেন দুই সাংবাদিক। এ ছাড়া শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্রে তথ্য সংগ্রহের জন্য গেলে গেটের সামনেই আটকে দেয়া হয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা ডটনেটের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট উজ্জল জিসানকে। এ সময় পুলিশের সামনেই তিন কিশোর তার মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেয় এবং লাঞ্ছিত করে। পরে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার শর্তে তার মোবাইল ফোনটি ফেরত দেয়া হয়।