দ্য আজাদ স্টাফ
শহীদ তিতুমীরের ১৮৮ তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ
অনলাইন ডেস্ক
ব্রিটিশদের জিঞ্জির ভাঙার প্রয়াস চালানো সেই মহান বীর শহীদ সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরের আজ ১৮৮ তম শাহাদাত বার্ষিকী।
তিনি ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর আজকের এই দিনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ তিতুমীর একটি ইতিহাস ও একটি নাম যা মানুষকে আজও অনুপ্রেরণা দেয়। পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতিপ্রিয় নাম শহীদ তিতুমীর। স্বাধীনচেতা পালোয়ান তিতুমীরকে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী অসম্ভব ভয় পেত। ব্রিটিশের পালিত স্থানীয় জমিদাররা তাঁর নাম শুনে হতো আতঙ্কিত। ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে এ দেশের অসহায় মানুষকে মুক্তির জন্য তিনি আপসহীন সংগ্রাম করেছেন।
১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি (১১৮৮ বঙ্গাব্দ, ১৪ মাঘ) পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
সৈয়দ আহমদ বেলরভী (১৭৮৬-১৮৩১) যখন মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর শিখদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত ঠিক তখনই বাংলাদেশে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর নামক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সিপাহসালারের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে জুলুম শোষণ ও নির্যাতনের মূলোৎপাটনের সংগ্রামে যে ক’জন দেশপ্রেমিক অস্ত্র ধারণ করে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমর হয়ে রয়েছেন, তিতুমীর তাদের মধ্যে অন্যতম।
তিতুমীরের সাথে প্রথম যুদ্ধ করতে আসেন ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার। সঙ্গে পাঠান পাইক, বরকন্দাজ প্রায় ৭৫০ জন। ইংরেজ সাহেবদের হাতে বন্দুক। কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর হাতে সড়কি, বল্লম ও তীরের অব্যর্থ নিশানা। ইংরেজ পক্ষের বহু পাইক বরকন্দাজ প্রাণ হারায়। প্রায় ৫০০ জমিদার সৈন্য ও ইংরেজ পরাজয় বরণ করে। ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। দ্বিতীয়বার যুদ্ধে আসেন কর্নেল স্কট। ১৮৩১ সালের ১ নভেম্বর মধ্যরাতে ইংরেজ সৈন্যরা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার কাছে পৌঁছে তা ঘিরে ফেলে। বহু গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তিতুমীরের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তিতুমীর অসীম বীরত্বের সাথে এই সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবিলা করেন। ইংরেজদের কামানের গোলায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। কেল্লার সামনে বীরবিক্রমে জুলুমের মোকাবিলা করে ১৮৩১ সালের ১১ নভেম্বর তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হন তার সঙ্গী-সাথী বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তিতুমীরের সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম মাসুদ যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইংরেজদের বিচারে তার ফাঁসি হয়। পরবর্তীতে তিতুমীরের ২২৫ জন অনুসারীর বিচারে জেল হয়।
তিতুমীরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন যে, বাংলার মুসলমানদের ইমান ও আকিদার দিক থেকে সবল করে এবং অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে শক্তিশালী করেই তবে তাদের মধ্যে যুদ্ধের আহবান জানানো যেতে পারে। তিনি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে তিনি জনগণকে সচেতন করতে থাকেন। তাঁর বক্তৃতা ও প্রচারকাজে অভাবিত জাগরণ দেখা দেয়। ধর্মীয় অনুশাসন সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এই দুটি ছিল তাঁর মৌলিক কর্মসূচী। তাঁর আহবান ছিল বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদ সংস্কার করে নামাজের ব্যবস্থা করা, পূঁজার চাঁদা দান কিংবা তাতে অংশ নেয়া থেকে মুসলমানদের বিরত রাখা, শিরক-বিদায়াত হতে দূরে থাকা, মুসলমানদের মুসলিম নাম রাখা, মুসলমানদের ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি বা পাজামা পরা, পীরপূঁজা ও কবরপূঁজা না করা ইত্যাদি। তিতুমীরের ধর্মীয় দাওয়াতের মূলকথা ছিল, জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসুলের (স.) নির্দেশ পরিপালন সম্পর্কিত। এটি ছিল মূলত ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুণর্গঠনের এক বৈপ্লবিক কর্মসূচী।
সুসজ্জিত আধুনিক অস্ত্রের সামনে তিতুমীরের লাঠি আর তীর সড়কি ছাড়া কোন অস্ত্রই ছিলনা। তবে গুলীর মুখে এই দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষগুলি পিছে হটেনি। ইংরেজ বাহিনীর গুলীর মুখে তিতুমীর ও তার সঙ্গীরা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। নির্বিচাওে গুলী চালাতে থাকে ইংরেজ সৈন্যরা। গুলীতে তিতুমীর, তাঁর পুত্র গরহর আলীসহ ৫০ জন নিহত হয়। ২৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রাম তল্লাসি করে আরও ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এলাকার বাড়ীঘরগুলিতে আগুন দেয়া হয়। তিতুমীরসহ মৃতদেহগুলিকে প্রকাশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যাতে তাঁদের শহীদ হিসেবে কেউ সম্মান দেখাতে না পারে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৯৭ জনের বিচার হয়। তন্মধ্যে তিতুমীরের প্রধান সহকারী গোলাম মাসুমের প্রাণদন্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন, ১২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। বিচারকালে ৪ জনের মৃত্যু হয়। এই অসম যুদ্ধ সম্পর্কে ইংরেজ সেনাপতি নিজেই বলেছেন, যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি সত্য, কিন্তু জীবন দিয়েছে ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক এক মহাপুরুষ।
তিনি বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘একটু পরেই হয়তো আমরা ইংরেজদের আক্রমণের শিকার হবো। তবে এতে ভয় পেলে চলবে না। এই লড়াই শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে। আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।’
আজ থেকে প্রায় পৌনে দুশ’ বছর আগে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিতুমীর প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বীর তিতুমীর তার বীরত্বের জন্যই ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। জীবনের বিনিময়ে তিনি সত্যের পথে লড়াই করেছেন। তাঁর এই দৃঢ়তা ও অনবদ্য প্রেরণা আজও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানকে অনুপ্রাণিত করে।