দ্য আজাদ স্টাফ
সিইসি’র একক সিদ্ধান্ত এখতিয়ার বহির্ভূত
নির্বাচন কমিশন কোনো একক সত্তা নয়। এটি একটি যৌথ সত্তা। চারজন কমিশনার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার মিলেই নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই বলে মনে করেন বিশিষ্টজন ও আইনবিদরা। তারা বলছেন, নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ইসিতে যে মতবিরোধ প্রকাশ পেয়েছে তা কমিশনের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নির্বাচন কমিশনে ৩৩৯টি পদে নিয়োগ নিয়ে রোববার চার নির্বাচন কমিশনার ইউনোট দেন। এ কার্যক্রমে কমিশনারদের সম্পৃক্ত করা হয়নি বলেও অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া গতকাল কমিশনার মাহবুব তালুকদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চার কোটি আট লাখ ব্যয়ের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে জানান, এর কোনো কিছুই কমিশনকে জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, চারজন কমিশনার এবং প্রধান কমিশনার মিলেই কিন্তু নির্বাচন কমিশন। এখানে যা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সব কমিশনার মিলেই নিতে হবে। একক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে এ ধরনের মত বিরোধের কথা যখন গণমাধ্যমে আসে বিষয়টি খুব চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত কমিশনের ওপর মানুষের আস্থার পরিমাণ খুব কম। এ ধরনের ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার পরিমাণ আরো কমবে বলে আমার মনে হয়। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন বলতে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বোঝায় না। চার কমিশনার এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পাঁচজন মিলেই কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। নিয়োগ ও এ সংক্রান্ত আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ যে কোনো বিষয়ে কমিশন সভায় সকল কমিশনারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন কমিশন সচিবের। কোন বিষয়ে অন্য কমিশনাররা যদি না চায় বা না মানেন তবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে না। একজনকে কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি। সকল ক্ষমতা কমিশনের। আর কমিশন মানে হচ্ছে পাঁচজন। যেহেতু নির্বাচন কমিশনের ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ নিয়ে চার কমিশনার এরই মধ্যে প্রতিবাদ করেছেন তার মানে হচ্ছে এই নিয়োগ কমিশন সভার সিদ্ধান্তে হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়া আবার নতুনভাবে করতে হবে। আর সেটা যদি করা না হয় তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এর দায় নিতে হবে। তিনি বলেন, ৩৩৯ জন লোক নিবেন, এটা কি একক সিদ্ধান্তে হয়ে যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। নিয়োগের বিষয় ও এ সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বর্হিভূত নির্বাচন কশিনের সিনিয়র সচিবের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ড. তোফায়েল বলেন, প্রশাসনতো সরকার চালায়। এর কারণে তাদের এত দৌরাত্ম। তারা যেটা বলে সেটাই আইন হয়ে যায়। এ কারণেই তারা বলছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন আইন ভঙ্গ হয়নি এটা হচ্ছে প্রশাসনের ঔদ্ধত্য। তবে চার কমিশনারই যেহেতু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না বলে মতামত দিয়েছেন সেহেতু এ নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে পারে না। এখন যে প্রশ্নটা আসছে তা হলো কমিশনের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক এর (সুজন) সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন একটা যৌথ সত্ত্বা। তাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। চার কমিশনারকে বাদ দিয়ে যেভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে এটা গ্রহণযোগ্য না। নির্বাচন কমিশনের যেকোন বিষয় কমিশন সভায় পাঁচ কমিশনারের মতামতের ভিত্তে নিতে হবে। যেহেতু চার কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং এর ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মতামত নেয়া হয়নি বলেছেন, তার মানে এটা স্পষ্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়টি কমিশন সভার মধ্য দিয়ে আসেনি।
গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাকে ইউনোট (আন অফিসিয়াল নোট) দেন চার কমিশনার। এতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় গঠিত। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারি কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে অর্পিত সকল দায়িত্ব পালন করবে। এবং সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়ী থাকবেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য অনুমোদিত বাজেট নির্ধারিত খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় অনুমোদনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হবেন; বরাদ্দকৃত অর্থ যেসব খাতে ব্যয় হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত এবং কমিশন কর্তৃক অনুমোদন আবশ্যক। মাঝে মধ্যে নির্বাচন প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত কোনো কোনো বিষয় উপস্থাপন করা হলেও অন্য কোনো আর্থিক বিষয়ে কমিশনকে অবগতও করা হয় না। যা নির্বাচন কমিশন আইন, ২০০৯ এর ১৬ ধারার সুস্পষ্ট লংঘন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯ এর ধারা ৪সহ অন্যান্য ধারা বর্ণিত কমিশনের ওপর অর্পিত সকল কার্যাদিতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কমিশনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তদুপরি সচিবালয় এককভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, তা গত ১৪ই নভেম্বরের কমিশন সভায় সিনিয়র সচিব তুলেও ধরেছেন। যা সংবিধান, গণপ্রতিনিত্ব আদেশ ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯ ও সংশ্লিষ্ট বিধির সুস্পষ্ট লংঘন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনের সব বিষয়ে সংবিধানসহ বিদ্যমান সকল আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হবে। একইসঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
এতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০১০ এর ৫(১) ধারায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওপর ন্যন্ত থাকবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে; এবং একই আইনে ১৪(১) ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়ী থাকবেন। আইনের ১৪(২) উপধারা মোতাবেক, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারি, নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে সচিবের কাছে দায়ী থাকবেন।
কমিশনারদের অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর গতকাল তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সবকিছু হয়েছে। নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। ৯০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার জন্য ইসি, পিএসসি, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নিয়োগে কোনো অনিয়ম হলে কমিশন তদন্ত করে দেখতে পারে। কমিটির সুপারিশ কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী আমি সিইসির কাছে উপস্থাপন করেছি। ২০০৯-১০ সাল থেকে নিয়োগ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম এভাবেই পরিচালিত হয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, সমপ্রতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ১২ থেকে ২০ তম গ্রেডের ৩৩৯ জন কর্মচারি নিয়োগ দেয়া হয়। ওই পদের বিপরীতে ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন আবেদন করেন। এ নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনায় ইসির ব্যয় হয় ৪ কোটি ৮ লাখ টাকা। জালিয়াতির দায়ে মৌখিক পরীক্ষায় ১৩৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়। যুগ্ম সচিব কামাল উদ্দিন বিশ্বাসের নেতৃত্বে ইসির জনবল শাখা এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। উৎস: মানবজমিন